পৃথিবীতে খুব শীঘ্রই একটা সময় আসবে, মানুষের সমস্ত কাজ প্রযুক্তি করে দেবে শুধু করতে পারবে না একটা জিনিস। সেটা হচ্ছে, তাকে শারীরিকভাবে ন্যাচারালি ফিট রাখা। প্রযুক্তি মানুষকে ক্রমাগত এতই আরাম আর আয়েশ দিচ্ছে যে, ভবিৎষত পৃথিবীতে মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই আর কোন কাজ করতে হবে না। মানুষ শুয়ে বসে দিন কাটাবে, ফলে বাড়বে তার অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করার সম্ভাবনা, শারীরিক ঝুকিঁ এমনকি মেদ হয়ে বা উচ্চ রক্তচাপে মৃত্যু ঝুকিঁও। ঠিক সেই মহুর্তে মানুষের প্রয়োজন হবে এমন একটি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবস্থার যেটা তার স্বাস্থ্যগত বিষয়ে তাকে সাহায্য করবে।
প্রচন্ডরকম দূরদর্শী ও চৌকস এ্যাপেল কোম্পানি বেশ কয়েক বছর আগে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এইরকমই একটি ভবিৎষত-প্রযুক্তি নিয়ে গবেষনা করতে। তারই ফলশ্রুতিতে ভবিৎষত পৃথিবীর স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের জন্য পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি নিয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে নামলো টেক জায়ান্ট স্বয়ং এ্যাপেল!!
কিছুক্ষন আগে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এ্যাপেল অফিসিয়ালি ঘোষনা দিলো Apple Watch রিলিজ করার, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা যার নাম দিয়েছে আইওয়াচ। তো এ্যাপেল ইতিমধ্যেই iWatch এর ঘোষনা আর প্রেজেনটেশান দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আমার তো ধারনা, আজকের এ্যাপেল ইভেন্টে, প্রাযুক্তিক উৎকর্ষে আইফোন ৬, প্লাস আর আইওএস ৮কেও ছাপিয়ে গেছে আইওয়াচ। [উপস্খিত দর্শকরা নির্বাক বিস্ময়ে আইওয়াচের প্রেজেনটেশান দেখেছে এবং দেখা শেষ করে টুইটার আর ফেসবুকে ঝড় তুলেছে। সে সব দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ] তাই ভাবছি iOS 8 বা iPhone 6/Plus নিয়ে তো অনেকেই জানেন, (যারা জানেন না তারা একটু গুগলে ঘাটঁলেই পাবেন) তাই আর ওসব নিয়ে প্যাচাল না পেড়ে বিশ্ববাসির জন্য একদম আনকোড়া নতুন প্রযুক্তি ’আইওয়াচের’ ব্যাপারে কিছু লেখা যাক।
গত বছর যখন খবর পেয়েছিলাম যে এ্যপেল পৃথিবী বিখ্যাত কয়েকজন ফিজিশিয়ান, বায়োকেমিষ্ট আর ন্যানো ফাইবার ইঞ্জিনিয়ার তাদের কোম্পানিতে নিয়োগ দিয়েছে, তখনই আচঁ করতে পেরেছিলাম যে, এ্যাপেল নিশ্চয়ই এমন কোন ইলেকট্রিক ডিভাইস বানানোর কাজে হাত দিয়েছে যেটা মানুষের স্বাস্থগত বিষয়ে নজরদারি করবে এবং একই সাথে তাকে ন্যাচারালি ফিট থাকতে সাহায্য করবে। ভবিৎষত পৃথিবীতে মানুষের সব কাজ প্রযুক্তি করে দিলেও মানুষ যেন নিজেকে কর্মক্ষম বা সচল রাখার একটা তাগিদ অনুভব করে। আইওয়াচ ঠিক তাই করবে, মানে নিয়মিত ব্যায়াম ট্যায়াম করা আপনার অভ্যাসে না থাকলেও সে কোন না কোনভাবে আপনাকে দিয়ে প্রয়োজনীয় এক্সারসাইজটুকু করিয়ে নেবে।
কিছুক্ষন আগে এ্যাপেল প্রধান টিম কুক উপস্থাপিত আইওয়াচের লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং দেখে বুঝতে পারলাম, এটা নিঃসন্দেহে একটা অসাধারন ও অভূতপূর্ব প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ এমনটা এর আগে কখনো দেখেনি। আমরা ধারনা, এ্যাপেল কর্তৃক প্রর্বতিত আইফোন ও App Store এর ধারনা গত ১ দশকে প্রযুক্তি বিশ্বকে যেমন আমুল বদলে দিয়েছে, তেমনি iWatchও বায়োমেট্রিক আর মানুষের স্বাস্থ্যগত ধারনার জগত আমুল বদলে দেবে। এক আইফোন দিয়ে যেমন গত প্রায় ১ দশক ধরে এ্যাপেল এক চেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে, আমার ধারনা iWatch হতে যাচ্ছে এ্যাপেলের সেইরকম আরেকটি পণ্য যেটা দিয়ে তারা আগামী অন্তত আরো ১ দশক চুটিয়ে ব্যবসা করে যাবে।
এইরকম আরেকটা পরিধানযোগ্য পন্য এনেছিলো গুগল - তাদের গুগল গ্লাস। কিন্তু ওটা মনে হয় প্রায় ফ্লপ একটা প্রজেক্ট ছিলো। কারন বাজারে বা প্রযুক্তি দুনিয়ায় সেটা নিয়ে তেমন একটা মাতামাতি দেখিনি, বাজারেও ছাড়া হয়েছিলো খুবই সীমিত আকারে, যেন গুগলের আরেকটি পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট। বড় আকারে গুগল প্লাস কবে বাজারে আসবে, তা কেউ জানে না। সে হিসেবে এ্যাপেল ওয়াচ অনেক বেশী ম্যাচুউরড একটা পণ্য।
আইওয়াচ বা এ্যাপেল ওয়াচ কি জিনিস?
আইওয়াচ হাত ঘড়ির মতো ছোট্ট একটা ডিভাইস যেটা কবজিতে পড়তে হয় এবং আইফোন ৫ এবং ৬ এর সবগুলো মডেলের সাথে কমপাটিবল। মানে আইফোন ৫/৬ এর সাথে এটা ডেটা সিংক করবে, আইফোনে সংযোগ থাকা ওয়াইফাই এবং জিপিএস ব্যবহার করে ইউজারকে লাইভ তথ্য দিবে। এতে বেশ কিছু এ্যাপ আগে থেকেই ইনসটল করা থাকবে এবং ব্যবহারকারী চাইলে আরো এ্যাপ নিতে পারবেন। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই ঘড়িটির নীচে অত্যন্ত শক্তিশালি ও অত্যাধুনিক ৪ টি সুদৃশ্য ইনফ্রারেড, দৃশ্যমান এলইডি আর ফটো সেন্সর রয়েছে যা দিয়ে মানব দেহের কারডিওভাসকুলার তথ্য (যেমনঃ পাসল রেট, ইত্যাদি) সঠিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষন করা সম্ভব।
আইওয়াচ বা এ্যাপেল ওয়াচ দিয়ে কি কি করা যাবে?
আইওয়াচের ফিচার লিষ্ট আদতে মাইল খানেক লম্বা। সাধারন কিছু কাজ যেমন গান শোনা, কল করা, এসএমএস পাঠানো বা ছবি তোলা ছাড়াও অসাধারন কিছু কাজ করা যাবে যেমনঃ আইওয়াচ দিয়ে সকালে মর্নিং ওয়াক করতে করতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারবেন অথচ আপনাকে জগিং ট্র্যাক বা রাস্তা থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দৃষ্টি সরাতে হবে না। আইওয়াচে থাকা ফেসবুকে এ্যাপ দিয়ে Siri এর সাহায্যে আপনি দৌড়াতে দৌড়াতেই স্ট্যাটাস আপডেট করতে পারবেন বা Siri কে দিয়ে মেইল চেক করা বা মিটিং মিনিট রেডি করাসহ অন্য যে কোন কাজ করাতে পারবেন। মানে যে এ্যাপগুলো ব্যবহার করতে আপনাকে এখন পকেট থেকে আইফোন বের করার কষ্টটুুক সহ্য করতে হয়, iWatch আপনার সেটুকু কষ্টও দূর করে দেবে। কবজি মুখের কাছে নিয়ে স্পেশাল এজেন্ট স্টাইলে Siri কে দিয়েই সব কাজ সারতে পারবেন, অথচ আপনার দু হাতের ১০ আংগুল থাকবে সম্পূর্ণ খালি!
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আইওয়াচ মানুষের স্বাস্থ্যগত ব্যাপারে পরিসংখ্যান রাখতে বিশেষভাবে দক্ষ। যেমনঃ হার্টবিট এবং রক্তচাপ মাপা, ক্যালোরি বার্ণ হওয়া, এক্সারসাইজ টার্গেট মেইনটেন্ট করা, কত দ্রুত - কত ক্ষন ধরে - কত মাইল দৌড়ানো হয়েছে/হচ্ছে সে হিসাব রাখা ইত্যাদি।
আগে তো মানুষ ক্যাশ টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরতো, তারপর আসলো ক্রেডিট কার্ড এখন ক্রেডিট কার্ড পকেটে নিয়ে ঘোরার দিনও শেষ। পেমেন্ট করুন এ্যাপেল ওয়াচ দিয়ে!
তবে আমি যেটাতে সবচে বেশী অবাক হয়েছি, সেটা হচ্ছে, iWatch এর অভূতপূর্ব চার্জিং প্রযুক্তি। পৃথিবীর আর কোন ইলেকট্রিক পণ্য যে প্রযুক্তি কখনো ব্যবহার করেনি। সেটা হচ্ছে, Wi-fi recharging technology! চাজিং দ্রুততর করতে চাইলে কেবলের ব্যবস্থাও আছে। আইওয়াচের নীচের ৪ টি সেন্সরের সাথে চৌম্বকীয় আংটা লাগিয়ে সেটা চার্জ দেযা যাবে। এ্যাপেলের পরিকল্পনা রয়েছে যে, মোশন, সোলার ও ইনডাকশন পদ্ধতিও ওটাকে চার্জ করানো। মানে আপনি যখন দৌড়াবেন, তখন আপনার শরীর থেকে যে এনার্জি, হিট-টেম্পারেচার বা ক্যালোরি বের হবে, সেসব দিয়ে চার্জ করানো এবং/অথবা সোলার পাওয়ার দিয়ে চার্জ করা।
ফিচার আর দক্ষতার কথা বাদই দিলাম, শুধু এটুকু বলি যে, আইওয়াচের যৌনাবেদনময়ী নকশা পৃথিবীর যে কোন প্রযুক্তি মনস্ক মানুষকে প্রথম দেখাতেই প্রচন্ডরকম মুগ্ধ করে ছেড়ে দেবে, যেমনটা আমাকে করেছে।
আগামী কয়েক বছরে, অন্য কোম্পানির বানানো আইওয়াচের মতো আরো অনেক আধুনিক পরিধানযোগ্য যন্ত্রপাতি আমরা বাজারে আসতে দেখবো, ইনশাল্লাহ ব্যবহারও করবো, কিন্তু এ্যাপেল সেই নতুন দুনিয়ার অগ্রদূত হয়েই থাকবে, এ্যাজ ইউজুয়াল!
iWatch রিলিজ হবে আর কয়েক মাস পরেই; খুব সম্ভবত ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। মূল্যঃ সাড়ে তিন শ ইউএস ডলার। সাথে থাকবে চামড়া, ধাতব অথবা প্লাস্টিকের বেল্ট। সমস্যা হলো, এটাকে কেউ আইফোনবিহীন ব্যবহার করতে পারবেন না, মানে এটা ব্যবহার করার সময় জামার পকেটে অবশ্যই আইফোন চালু থাকতে হবে। আপাততঃ আইওয়াচ Watch, Edition আর Sport - এই তিনটি সংস্করণে পাওয়া যাবে।
এ্যাপেল ওয়াচের আরেকটি দুর্দান্ত ফিচারের কথা না বল্লেই নয়। পুরনো ভায়াব্রেশন প্রযুক্তিকে এ্যাপল মুটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ্যাপল ওয়াচ আপনাকে ইনকামিং কল, ম্যাসেজ এবং এ্যালার্ট দিবে ভায়াব্রেশনের মাধ্যমে, মানে কল বা ম্যাসেজ আসলে আপনি আপনার হাতে কবজিতে হালকা কাপুনি টের পাবেন। ফলে আপনার ফোনের এলার্ট আপনি ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ টেরও পাবে না। এমনকি, জিপিএস নেভিগেশনের সময় যে দিকে মোড় ঘুরতে হবে, এ্যাপল ওয়াচ আপনার হাতের সেদিকে ভায়াব্রেট সিমুলেশন পাঠাবে! অভিনব এ প্রযুক্তির কথা শুনেই তো আমি মুগ্ধ!
এ্যাপল ওয়াচের আরো শ খানেক ছবি আছে এই লিংকেঃ
এ্যাপেল ওয়াচ নিয়ে খুব সম্ভবত এটাই বাংলাতে লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ রিভিউ
0 comments:
Post a Comment